মৌমাছির জীবন-যাপন, সামাজিকতার কিছু নিদর্শন ও এর আশ্চর্য কিছু গুণাবলি
একটি মৌমাছির ছবি |
মৌমাছি আমাদের সমাজের অত্যান্ত উপকারি একটি
প্রাণী। কিন্তু মৌমাছির কথা বললে প্রথমেই মধুর কথা মাথায় আসে কারণ মৌমাছি থেকে মধু
পর্যন্তই আমরা যায় এর বেশি যেতে পছন্দ করি না। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন যে
মৌমাছিরা এতটাই সামাজিক ও সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করে যা কোনোভাবেই আমাদের
সমাজ ব্যাবস্থার চেয়ে সামান্য কম কিছু নয়। বরং আমি তো মনে করি মানব সমাজের থেকে
তারা বেশি সুশৃঙ্খল। কারণ আমাদের সমাজে
প্রায় সময়ই বিশৃঙ্খলতা দেখা যায় কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে এইটা খুবই কম দেখা যায়।আপনার
মনে হয়তো প্রশ্ন ঘুরছে এই কথা কেন বলছি।কারণ এদের মধ্যে যেই সামাজিকতা,
সুশৃঙ্খলতা, নিয়মানুবর্তীতা, দায়িত্বশীলতার এতটাই প্রভাব চোখে পড়ে যা সত্যিই
অনুকরনীয়।এর কিছু নমুনা সংক্ষেপে আপনাদের সামনে তুলে ধরছি যা থেকে আপনারও এইটা
বুঝতে সুবিধা হবে।
মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করছে |
১।সমাজ
ব্যবস্থাঃ মৌমাছিদের সাধারণত তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করা হয়
ক)রানী খ)পুরুষ বা ড্রোণ গ)কর্মী বা বন্ধ্যা মৌমাছি। এদের সমাজ মাতৃ তান্ত্রিক।
অর্থাৎ রানীই এদের সমাজের প্রধান রানীই একটী মৌচাকের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
রানী একটি বিশেষ হরমোন প্রয়োগ করে যার মাধ্যমে মৌচাকের সকল মৌমাছিকে নিয়ন্ত্রণ
করে। আমাদের মানব সমাজে যেমন কাজকে ভাগ করে নিই। এদের মধ্যেও সেই প্রবণতা দেখা
যায়। এদের মধ্যে কর্মী মৌমাছি তেমনওই মধু সংগ্রহ করে থাকে।
মৌচাকের মধ্যে মৌমাছিদের অবস্থানের স্থিরচিত্র |
২।কাজঃ
মৌমাছিরা অত্যান্ত পরিশ্রমি ও সমাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এরা কখনো বসে থাকে না।
সর্বদা কাজ করতে থাকে। যেমনঃ একটি মৌমাছির বয়স যখন ৩-৪ দিন হয় তারপর থেকে সে
মৌচাকের আবর্জনা পরিষ্কার করে থাকে। আর ১৮ দিন বয়স হলে সে মৌচাক থেকে মধু আহরণ
শুরু করে। আর বৃদ্ধ বয়সে চাকের জন্য পানি সরবরাহের কাজ করে থাকে। আবার কোনো সময়
মৌচাকে কোনো রকম সমস্যা দেখা দিলে যে যার মতো ঝাপিয়ে পড়ে। যা মানুষের অন্যতম একটি
গুণ।
৩।যোগযোগঃ
সামাজিকতা রক্ষার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো যোগাযোগ। যোগাযোগ ছাড়া কোনোভাবে
সামাজিকতা রক্ষা করা সম্ভব হয়না।মৌমাছিদের মধ্যে তাই গুণটি যে থাকবে তা সহযেই
অনুমান কর যায়। এরা বিশেষ ধরণের গন্ধ, গুণগুণ শব্দ বা নৃত্যের মাধ্যমে যোগাযোগ
রক্ষা করে চলে। এরা যোগাযোগের মাধ্যমে কোনো স্থানের মধু সংগ্রহের খবর মৌচাকের অন্য
মৌমাছিদের দিয়ে থাকে। এমনকি কোনো বিপদের সংকেতও এরা বিশেষ ভাব বিনিময়ের মাধ্যমে
চাকের অন্য মৌমাছদের দিয়ে থাকে। যার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এরা বিপদ থেকে রক্ষা করে
নিজেদের।
মৌমাছিদের মধুসহ একটি মৌচাকে ফটো |
৪।খাদ্য নিরাপত্তাঃ বাচতে হলে খাবার
প্রয়োজন। বেঁচে থাকার জন্য খাবারের বিকল্প নাই। তাই প্রত্যেক সমাজের মতো মৌমাছিরাও
তাদের খাদ্যের অভাব দূর করতে সর্বদা খাদ্যের ওপর গুরুত্ত্ব দিয়ে থাকে। এরা শীতকাল
বা মধু আহরণের যেকোনো অনুকূল সময়ে প্রতিকূল পরিবেশের জন্য খাবার জমিয়ে রাখে। যার মাধ্যমে
তাদের ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ার এজন্য তাদের করতে হয় কঠোর পরিশ্রম।
এমনকি ভবিষ্যত প্রজন্মের যেন খাদ্য চাহিদা
পূরণ হয় সেই ব্যবস্থাও করে রাখে মৌচাকের অন্য মৌমাছিরা।
৫।স্বাস্থ্যরক্ষাঃ মানব সমাজের মতোই
মৌমাছিরাও স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যাপারে বেশ যত্নশীল। এরা নিয়মিত এদের মৌচাক পরিষ্কার
করে। এমনকি এরা রোগ দমন করতেও সক্ষম। এদের দেহে একধরণের বিশেষ এন্টিবায়োটিক জাতীয়
পদার্থ রয়েছে যা অনুজীব্দের শুধু সংখ্যাবৃদ্ধিই রোধ করেনা অনেক সময় এদের মেরে
ফেলতেও সক্ষম। আবার এরা মৌচাকের সংক্রমপণ রোগ দূর করতে সংক্রমিত মৌমাছিকে বা মৃত
মৌমাছিকে চাকের বাইরে ফেলে দেয়। যার মাধ্যমে মৌচাকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আবার
এদের তৈরি মৌচাক পরিবেশের তাপমাত্রার সাথে খাপখাইয়ে নিতেও সক্ষম। কোনো কারণে
মৌচাকের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে সব মৌমাছির মাথা একদিকে করে পাখা নাড়াতে থাকে। যার
মাধ্যমে এরা মৌচাকের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
মৌমাছির হূলের ছবি |
৬।আত্মরক্ষাঃ আত্ম্রক্ষা ছাড়া
কখনোই একটা জাতি শত্রুদের হাত থেকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না। মৌমাছিও
এর ব্যতিক্রম নয়।এদের এত পরিশ্রমের মধুতে অন্য কেউ ভাগ বসাতে আসলে তাকে হুল ফুটিয়ে
দেয়। এদের হুল অত্যান্ত বিষাক্ত। এদের কামড়ে ছোটখাট প্রানী থেকে ইদুর জাতীয়
প্রাণির জীবণনাশ হতে পারে। তবে এরা শান্তিপ্রিয় কেউ এদের ক্ষতি করতে না আসলে এরাও
কারো ক্ষতি করে না।
৭।অধিকারের জন্য
লড়াইঃ আমরা
আমাদের সমাজে প্রায়শই দেখে থাকি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম অধিকার আদায়ের জন্য
বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি যা গণতান্ত্রিক সমাজের একটা অধিকার। তেমনই
মৌমাছিরাও গণতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসি। এরা এদের রানীকে শ্রদ্ধা করলেও বা রানীর
নির্দেশে সকল কাজ সম্পাদন করলেও এরাও রানীর জুলুম কখনোই মেনে নেয়না। এর জন্য এরাও
প্রতিবাদ করে। এমনকি এরা রানীকে মেরে পর্যন্ত ফেলে। মানব সমাজে মাঝে মাঝে
গণতান্ত্রিকতার অবলুপ্তি ঘটলেও এদের ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা হয়না। যেমন কোনো মৌচাকে
যদি মৌমাছির সংখ্যা বেশি হয় সেক্ষেত্রে রানীর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও সেই চাক ছেড়ে
কিছু মৌমাছি নিয়ে নতুন চাকে যেতে হয়। এই মৌমাছি অন্যচাকে তারা একটা লার্ভা
নির্বাচন করে এবং সেটাকে রাজসিক জেলি খাইয়ে একটি মৌমাছিদের রানীতে পরিনত করে।
যার নেতৃত্বে পরবর্তীতে চলে পুরো মৌচাক।
আর এভাবেই এরা এদের নতুন রানী নির্বাচন করে থাকে। যা গণতন্ত্রের এক অন্যতম শিক্ষা।
মৌমাছির মধু সংগ্রহ করতে যাওয়ার দৃশ্য |
৮।চুরি-ডাকাতিঃ যেখানে সম্পদ
থাকবে, সমাজ থাকবে , সেখানে চুরি-ডাকাতি হবে। মৌমাছিরাও ঠিক তেমনি। এরা কোনো চাকে
মধুর সন্ধান পেলে অনেক সময় আক্রমণ করে বসে। লুট করে মধু।
৯।বুদ্ধিমত্তাঃ মৌমাছিরা অত্যান্ত
বুদ্ধিমানও বটে। এরা কোনো স্থানে মধুর সন্ধান পেলে সবচেয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে
শরটকার্ট রাস্তাটি খুজে বের করে নেই। যার কারণে খুব দ্রুত কোনো ফুলের বাগান বা ফুল
থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে। তাই বুদ্ধিমত্তাতেও এরা যে অনন্য তা বলাই বাহুল্য।
তাই বলতে গেলে সামাজিকতা রক্ষার যতগুলো গুণ থাকা উচিত, তার সবগুলোই
রয়েছে এই মৌমাছিদের মধ্যে। তাই এদের মধ্যে যেই নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, দায়িত্বশীলতা
দেখা যায় তা আমরা আমাদের জীবনে শিক্ষা হিসেবে নিয়ে কাজে লগাতেই পারি। তারা প্রানী
হিসেবে ছোট হলেও দায়িত্বশীলতার ও সামাজিকতা রক্ষার এক অন্যরকম উদাহরণ।